১. ক্রসফায়ার কি আইনসিদ্ধ? ২. ক্রসফায়ার কি নীতিসিদ্ধ? ৩. ক্রসফায়ারের বিষয়ে সরকারের বক্তব্য কি? ৪. রাষ্ট্রের আইন প্রণয়নের সূতিকাগার সংসদে ক্রসফায়ার নিয়ে কী কী কথা হয়? ৫. সাধারণ মানুষ ক্রসফায়ারকে কী চোখে দেখে? ৬. ক্রসফায়ার কি অপরাধ দমনে কার্যকর? ৭. কোন কোন অপরাধের জন্য বিচার ছাড়া (অর্থাৎ লোকটির অপরাধের কোনরূপ কোনো প্রমাণ ছাড়া) তাকে ক্রসফায়ারে হত্যা করা যায়? ৮. কী ধরণের রাষ্ট্র বা সমাজ ব্যবস্থায় সরকারের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে থাকা মানুষরা অবলীলায় ক্রসফায়ারকে সমাধান হিসাবে মেনে নেয় এবং প্রচার করে?প্রশ্নগুলো আমি পাঠকের জন্য রেখে গেলাম। প্রশ্ন আরও করা যেত। প্রশ্নগুলো করছি এ কারণেই, গত কয়েক বছরে সংসদে এবং সংসদের বাইরে আইন প্রণেতা এবং বিভিন্ন পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিবিদরা এমনভাবে ক্রসফায়ার বা বিচার বহির্ভূত হত্যার পক্ষে কথা বলেছেন যাতে দেখা গেছে এমনকি পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে এর সাথে জড়িত সিন্ডিকেটের কয়েকজনকে ক্রসফায়ার করাকে সঠিক পথ বলে মনে করছেন।এই দেশে আলোচিত ধর্ষণের ঘটনা ঘটে নিয়মিত বিরতিতেই। বেশ কিছুদিন আগে তেমন এক ঘটনায়ও সংসদে ধর্ষণকারীর ক্রসফায়ার চেয়েছিলেন জাতীয় পার্টি, আওয়ামী লীগ আর তরিকত ফেডারেশনের এমপিরা। আবার একটা বর্বর ধর্ষণের ঘটনা ঘটল সিলেটের এমসি কলেজে। দেশব্যাপী তুমুল আলোচিত হল। এবার আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ জোর দাবি জানালেন ক্রসফায়ারের। তিনি বলেন, “আমার যদি সুযোগ থাকত, আমি এটাই বলতাম, এদেরকে বিচারের কাঠগড়ায় নয়, এরদেরকে সরাসরি ক্রসফায়ারে দিয়ে দিতে।যদিও আমরা ক্রসফায়ারের বিরুদ্ধে, নির্বিচারের হত্যার বিরুদ্ধে। তারপরেও আমি বলি, এরা পশু। এরা কোনো মানুষের কাতারে পড়ে না। যারা এই ধরনের পাশবিক নির্যাতন করে এদের সঙ্গে পশুর তুলনা করা ছাড়া উপায় নাই। এই পশুগুলোকে অহেতুক বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় না করিয়ে ধরে ধরে সরাসরি ক্রসফায়ার দেয়া দরকার।এরপর ঘটলো নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়ার মত বর্বরতম ঘটনা। এই দেশে চরম বিচারহীনতার মধ্যে দীর্ঘকাল বাস করতে করতে এই দেশের খুব উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ এমনিতেই বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পক্ষে। বেগমগঞ্জের বর্বরতা দেখার পর ফেইসবুকে ধর্ষণকারীদের ক্রসফায়ার চাওয়ার পরিমাণ বেড়ে গেল। শুধু তাই না, এই দলে নাম লিখালেন বিখ্যাত কবি এবং সাংবাদিকও।জনগণ খুব ভালভাবেই জানতো এসব তথাকথিত ক্রসফায়ার/বন্ধুকযুদ্ধ/এনকাউন্টার এর মানে আসলে ঠাণ্ডা মাথায় মানুষ খুন করা। তবে সরকার আগে কিছুটা রাখঢাক করতো, এসব হত্যার একটা গল্প বানাতো। কিন্তু এখন আর সেটাও নেই। কিছুদিন আগেই আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা কয়েকবারের মন্ত্রী আমির হোসেন আমু জার্মান সংবাদ সংস্থা ডয়েচে ভেলেকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, “সমাজের যে সমস্ত জিনিস আজকে বেরিয়ে এসেছে,আজকে জঙ্গিবাদ যেভাবে দানা বেঁধেছিল,যেটা চরম আকার ধারণ করেছিল,বিশ্বে যেভাবে এটা ছড়িয়ে পড়েছে,তখন যদি এইভাবে ক্রসফায়ারের সিদ্ধান্ত নেওয়া না হতো, তাহলে আমার মনে হয়, এটা দমানো সম্ভব ছিল না। ঠিক তেমনিভাবে জঙ্গিবাদসহ যে উচ্ছৃঙ্খলতা, মাদকতা যেভাবে এইদেশে বিস্তার লাভ করছে এবং তাদের ব্যাপারে জিরো টলারেন্স ঘোষণার পরেও কিন্তু থামানো যাচ্ছে না। সেই ক্ষেত্রে যদি অন-দ্য-স্পট গুলি করা হয়, এটা রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে নয়,জাতীয় প্রয়োজনে করা হচ্ছে ৷একজন মানুষের মৃত্যুর বা বিচারের ভার ‘অন দ্য স্পট গুলি’র উপর ছেড়ে দেওয়া যায় কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,“একজন মানুষের কার্যক্রম যদি হাজার মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়,একজন মানুষের কার্যক্রম যদি লাখো মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়,তাকে (তার) বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই”।বক্তব্যটি এমন একজনের যিনি কয়েকবারের এমপি এবং মন্ত্রী ছিলেন। এর আগেও আমি বেশ কিছু সাংসদের কথা লিখেছিলাম যারা সংসদে পর্যন্ত ক্রসফায়ারের পক্ষে মত দিতে দ্বিধা করেননি। তাহলে এখন কেবল আইন পাশের অপেক্ষা। যত হাস্যকরই শোনাক বাংলাদেশে এখনো সংবিধান বলে একটা বিষয় আছে। সংবিধান হল দেশের জনগণের সাথে রাষ্ট্রের চুক্তি। এই চুক্তি মানতে রাষ্ট্র বাধ্য। এই চুক্তির ২৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। ৩১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আইনের আশ্রয়লাভ, আইন অনুযায়ী ও কেবল আইন অনুযায়ী ব্যবহারলাভ যে কোন স্থানে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং বিশেষত আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোন ব্যবস্থা নেয়া যাবে না যাতে কোন ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে। আইনের উপর জোর দিয়ে ৩২ অনুচ্ছেদও স্পষ্ট বলছে আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতা হতে কোন ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাবে না। ৩৩ অনুচ্ছেদ দিচ্ছে গ্রেফতার ও আটক ব্যক্তিকে রক্ষা কবচ। অর্থাৎ রাষ্ট্রের কোন নাগরিকের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে হলে কেবল মাত্র আইন অনুযায়ীই নিতে হবে। আইনানুযায়ী ব্যতীত কোন ভাবেই কোন নাগরিকের বিরুদ্ধে কোন প্রকার ব্যবস্থা নেয়া যাবে না। আবার সংবিধানের ৭(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংবিধান দেশের সর্বোচ্চ আইন এবং এর সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ যে কোন আইন যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ ততখানি বাতিল হবে। রাষ্ট্রের সাথে জনগণের চুক্তি হিসাবে সংবিধানের প্রতিটি ধারা সরকার মানতে বাধ্য এবং এমন কোনও আইন করা যাবে না যা কিনা সংবিধানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সংসদে এবং সংসদের বাইরে বারবার তীব্রভাবে ক্রসফায়ারের বিরোধীতা করা সত্ত্বেও এই লেখায় আমি ক্রসফায়ারকে বৈধতা দেবার প্রশ্ন তুলছি। কেন?আরপিও এর ১৯ ধারায় উল্লিখিত বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া সংবিধানের ৭(১) অনুচ্ছেদের ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ’ ১১ অনুচ্ছেদের ‘প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে’ সরকার পরিচালিত হওয়া এবং ৬৫(২) অনুচ্ছেদের ‘প্রত্যক্ষ নির্বাচন’ অনুষ্ঠানের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক।উপজেলা পরিষদ আইনের ২৫(১) ধারায় সংসদ সদস্যদের উপজেলা পরিষদের উপদেষ্টা করে তাকে বাদ দিয়ে নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যানদের কার্যত কিছু না করতে পারা সংবিধানে স্থানীয় শাসন সংক্রান্ত অনুচ্ছেদ ৫৯ এবং ৬০ এর সম্পূর্ণ পরিপন্থী।সর্বোপরি সংবিধানেই পরস্পরবিরোধী অনুচ্ছেদের অস্তিত্ব আছে। ১১৫ এবং বিশেষ করে ১১৬ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতির উল্লেখ থাকা মানেই বিচার বিভাগে নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি কার্যত নির্বাহী বিভাগের হাতেই ন্যাস্ত আছে। অথচ সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদ, যা রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির অংশ, আমাদের বলছে –‘রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গসমূহ হইতে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ রাষ্ট্র নিশ্চিত করিবেন’। জুরিসপ্রুডেন্স এর একেবারে গোড়ার কথা হচ্ছে ‘No parliament can bind a future parliament’ অর্থাৎ কোনও সংসদ এমন কোনও আইন পাস অথবা সংবিধানে এমনভাবে পরিবর্তন করতে পারে না যেটা অপরিবর্তনীয় বা ভবিষ্যতের কোনও সংসদ সেই আইন অথবা সংবিধানের কোনও সংশোধন করতে পারবে না। কিন্তু পঞ্চদশ সংশোধনীতে অনুচ্ছেদ ৭(খ) যুক্ত করার মাধ্যমে সংসদ নিজেই নিজেকে বেঁধে ফেলে সংবিধানের অর্ধ শতাধিক অনুচ্ছেদ সংশোধনের অযোগ্য বলে ঘোষণা করেছে। এটা জুরিসপ্রুডেন্স এর মূলনীতির পরিপন্থী। মৌলিক কাঠামো সরিয়েই রাখি, কোনও সংসদ সংবিধানের কম গুরুত্বপূর্ণ কোনও অনুচ্ছেদও এভাবে চিরদিনের জন্য সংশোধনের অযোগ্য ঘোষণা করা যায় না। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী শুধুমাত্র যে সংসদের সার্বভৌমত্বকে হুমকির মুখে ফেলেছে তাই নয়, এর মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের রিভিউ ক্ষমতাকেও প্রকারান্তরে সীমিত করা হয়েছে। আরও মজার কথা হল একই সংবিধানে অনুচ্ছেদ ৭(খ) আর ১৪২ পরম মমতায় পরস্পরের সাথে অবস্থান করছে। যেখানে ৭(খ) বলছে কিছু অনুচ্ছেদ কখনই কোন ভাবেই পরিবর্তনীয় নয় সেখানে ১৪২ পরিষ্কার বলছে সংবিধানের অন্য কোনও ধারায় যাই থাকুক না কেন দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যা গরিষ্ঠের সমর্থন থাকলেই এর যে কোন অনুচ্ছেদ সংশোধনযোগ্য।ফিরে আসা যাক বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের প্রসঙ্গে। কিছুদিন আগে টেকনাফে মেজর সিনহা রাশেদ হত্যাকাণ্ডের পর আমরা জানতে পারি টেকনাফের কুখ্যাত ওসি প্রদীপ পুলিশের সর্বোচ্চ পদক বিপিএম পাবার ক্ষেত্রে তার ‘বীরত্বের’ যে ছয়টি ঘটনা উল্লেখ করেছেন সেগুলোর সবগুলোতে অভিযুক্ত মারা গেছে। অর্থাৎ এই রাষ্ট্র আক্ষরিক অর্থেই বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে স্বীকৃতি দেয়, সাথে পুরস্কৃত করে উৎসাহিতও করে।ক্ষমতাসীন দলের এমপি সংসদে, যুগ্ম-মহাসচিব সংসদের বাইরে নানা অপরাধে অভিযুক্তকে ঠাণ্ডা মাথায় গুলি করে মানুষ হত্যার আহ্বান জানিয়েছেন। আর সরকার যে ঠাণ্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নিয়ে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে সেটা মানুষ জানতো সব সময়ই। এই ব্যাপারে উপরে উল্লিখিত জনাব আমির হোসেন আমুর স্পষ্ট বক্তব্য আমাদের জানাটাকেই নিশ্চিত করেছে, প্রকাশিত করেছে।বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে এখন আর মুখোশেরও ধার ধারছে না সরকার। সাথে বহু ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি এক ধরণের হতাশা থেকে দেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পক্ষে থাকে। বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে একটা আইনি কাঠামোর মধ্যে নিয়ে এসে এটাকে অন্তত আইনগত বৈধতা দেয়া হোক। এতে সচেতন নাগরিকরা সেই আইনের সমালোচনা করবেন, বলার চেষ্টা করবেন এই আইন সংবিধান এবং মানবাধিকারের পরিপন্থী। এমন সমালোচনা তো ডিজিটাল সিকিউরিটি এক্ট এর ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩, ৫৩ ধারা নিয়েও আছে, কিন্তু তাতে কি সরকারের কোনও সমস্যা হচ্ছে? বরং সরকার বলতে পারছে তারা যা করছে সব আইনগতভাবে করছে।এই দেশে সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক আইনের অস্তিত্ব আছে। এই দেশের সংবিধানে পরস্পরের সাথে সাংঘর্ষিক অনুচ্ছেদ আছে; আছে জুরিসপ্রুডেন্স এর মূলনীতির একেবারে পরিপন্থী অনুচ্ছেদ। আর আছে সংসদে সীমাহীন সংখ্যাগরিষ্ঠতা। তাহলে যে কোনও বিষয়ে আইন পাস করতে সমস্যা কোথায়? বিশেষ করে তা যখন ডেমাগগ রাজনীতিবিদদের উদোম হয়ে পড়া মুখের ওপর কিছুটা হলেও মুখোশ পরাবে।
আপনার মতামত লিখুন :