দেশের দুগ্ধশিল্পের কেন্দ্রবিন্দু ও নিউজিল্যান্ড খ্যাত জনপদ শাহজাদপুরের বিস্তৃর্ণ বাথানসহ পার্শ্ববর্তী এলাকা
(বাঘাবাড়ী মিল্কশেড এরিয়া) দিনে ৩ থেকে সাড়ে ৩ লাখ লিটার গরুর দুধ উৎপাদিত হয়। প্রথমে এক ইংরেজ শাসক লর্ডলিন লিথদো ও পরে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত ধরে বিশাল ওই বাথানের গোড়াপত্তন হয়। ওই বাথান ভূমিকে ঘিরেই দেশের মোট দুধের চাহিদার ৬০ থেকে ৭০ ভাগ সরবরাহ করে এ অঞ্চলের খামারীরা। বাথান ভূমির সিংহভাগ সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলায় অবস্থিত, আর বাকি অংশ পাবনা ও নাটোর জেলার চলনবিল অংশে বিস্তৃত। আগে বাথান ভূমির আয়তন প্রায় ১৬’শ একর জুড়ে বিস্তৃত থাকলেও নানা কারণে বর্তমানে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩ একরে। ১৯৮৩ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশবলে পুরো ১৬’শ থেকে ১৭’শ একর জায়গা উদ্ধার করে মিল্কভিটার মাধ্যমে সমবায়ী দুগ্ধ খামারীদের ইজারা দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। মিল্কভিটা কর্তৃপক্ষের সুপারিশ অনুসারে স্থানীয় ভূমি অফিস বিভিন্ন প্রাথমিক দুগ্ধ সমবায় সমিতির অনুকূলে বাথান ভূমি ইজারা দিয়ে আসছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বাথান ভূমির প্রায় ৫’শ থেকে ৬’শ একর জায়গা ভূমিদস্যুরা জাল দলিল, ভুয়া পত্তনি, বেদখল, অবৈধ উপায়ে নেয়া ইজারাসহ গাঁয়ের জোরে দখল করে নিয়েছে।
স্থানীয় গো-খামারীরা প্রতিদিন ওই বিপুল পরিমান দুধ বাথান ও গোহাল (খামার) থেকে সংগ্রহ করে মিল্কভিটা কারখানা, প্রান, এমোমিল্ক, আফতাব, আড়ং, টাটকা,আকিজসহ বিভিন্ন বেসরকারি ডেইরি প্রজেক্টের কুলিং সেন্টারে সরবরাহ করে যা
প্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে ঢাকাসহ সারাদেশে সরবরাহ করা হচ্ছে। বিগত এক পশুশুমারীর পরিসংখ্যানে প্রকাশ, শাহজাদপুর উপজেলায় গবাদীপশুর মোট সংখ্যা ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭শ’ ৮৫ টি। এর মধ্যে দেশী জাতের গরু সংখ্যা ৮৪ হাজার ৩শ’ ৭৬ টি। সংকর জাতের গরুর সংখ্যা ১ লাখ ২০ হাজার ১শ’ ২০টি। বেসরকারী দুগ্ধ খামার ৩ হাজার ৬ শ’৫০ টি। রেজিষ্ট্রিকৃত খামারের সংখ্যা ২ হাজার ৫ শ’ ৮৮ টি।
দেশী বকনা গরুর সংখ্যা ১৩ হাজার ৬ শ ৯২ টি, দেশী এঁড়ে বাছুরের সংখ্যা ২৮ হাজার ৩ শ’২০টি, বকনা বাছুরের সংখ্যা ১৯ হাজার ৫ শ’ ৩৬ টি। সংকর জাতের বকনার সংখ্যা ১৪ হাজার ২শ’টি, সংকর জাতের বকনা বাছুরের সংখ্যা ২৫ হাজার ৪ শ’ ৭৫ টি। এই বিপুল সংখ্যক গাভী থেকে বর্তমানে মিল্কভিটার বাঘাবাড়ী কারখানসহ অন্যান্য বেসরকারী দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাত কারাখানায় প্রতিদিন সকাল ও বিকাল দুই বেলায় দুধ সরবরাহ করে খামারীরা। জানা গেছে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এ অঞ্চলের গো -সম্পদের ওপর ভিত্তি করে বাঘাবাড়ীতে গড়ে ওঠে মিল্কভিটার বিশাল কারখানসহ নানা দুধ সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাত প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে মিল্কভিটা কর্তৃপক্ষের সহায়তায় অষ্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডসহ বিশ্বের নানা দেশের উন্নতজাতের ষাঁড়ের সঙ্গে স্থানীয় জাতের গাভীর প্রজননের মাধ্যমে উন্নত সংকরজাতের গাভীর জন্ম দেয়া হচ্ছে। শাহজাদপুরে বর্তমানে অষ্ট্রেলিয়ান, শাহীওয়াল, জার্সি, ফ্রিজিয়ান, এফ এস ও সিন্ধিসহ বিভিন্নজাতের সংকর গাভী রয়েছে।
খামারীরা জানায়, শাহজাদপুর উপজেলায় সবচেয়ে বেশী দুধ উৎপাদিত হয় পোতাজিয়ার জনবিচ্ছিন্ন বিস্তৃর্ণ বাথানসহ আশপাশের ছোট বড় অসংখ্য বাথান ও গো-খামারে। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে এসব এলাকায় সবচেয়ে বেশী দুধ উৎপন্ন হয়। প্রতিদিন সকার বিকাল দু’বেলায় হাজার হাজার ক্যানে ভ্যান ও ট্রলিযোগে দুধ পৌঁছে দেয়া হয় বাঘাবাড়ীর মিল্কভিটা কারখানাসহ নানা দুধ সংগ্রহ প্রতিষ্ঠানে।
স্থানীয় গো-খামারী খলিল মোল্লা বলেন, তার ৫০টি দুধেল গাভী রয়েছে। মিল্কভিটায় তিনি দুধ সরবরাহ করছেন। ৪-৫ জন রাখাল নিয়িমিত গাভীগুলো পরিচর্যা করছে। তবে বর্তমানে গো-খাদ্যের মূল্য বৃদ্ধি হওয়ায় খরচের তুলনায় দুধের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না।
মিল্কভিটার সাবেক পরিচালক বাবুল আক্তার জানান, শাহজাদপুরের বাথান ভূমি দেশের সবচেয়ে বড় গো-চারণভূমি। এখানকার খামারীরা সরকারকে বাৎসরিক খাজনা প্রদানের মাধ্যমে বাথান ল্যান্ডের জমি ভোগ করে। মিল্কভিটা কর্তৃপক্ষ প্রাথমিক দুগ্ধ সমবায় সমিতিগুলোর দুধ উৎপাদনের মাত্রার উপর ভিত্তি করে বাথানল্যান্ডের জমি লিজের জন্য শর্ত
সাপেক্ষে সুপারিশ করে।
স্থানীয় খামারীরা আরও জানায়, গবাদীপশু সমৃদ্ধ জনপদ শাহজাদপুরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে প্রায় সাড়ে ৩ লক্ষাধিক গো-সম্পদ। অনেকে শখে, অনেকে পারিবারিক দুধের চাহিদা মেটাতে, আবার অনেকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উন্নতজাতের গাভী লালন পালন করছেন। শাহজাদপুর উপজেলার বিভিন্ন বসতবাড়ী, বাথান ও গো-খামারে বিভিন্ন ধরনের উন্নতজাতের গাভী রয়েছে। তন্মদ্ধে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কোরিয়ান, অষ্ট্রেলিয়ান, শাহীওয়াল, ফিজিয়ানসহ দেশী জাতের গাভী। খামারীরা বলেন, ১টি অষ্ট্রেলিয়ান গাভী দৈনিক ১০ থেকে ২৫ লিটার দুধ দেয়। সেইসাথে, জীবদ্দশায় ১২-১৫ টি বাছুর জন্ম দিতে পারে। একটি ফ্রিজিয়ান জাতের গাভী প্রায় ১২-২৩ লিটার দুধ দেয়। অন্যান্য জাতের গাভীও আশাব্যঞ্জক দুধ দিয়ে থাকে। খামারীরা প্রাথমিকভাবে দুধ সংগ্রহ করে সেই দুধ মিল্কভিটার আওতাভূক্ত দুধ সমিতিসহ বিভিন্ন বেসরকারী দুগ্ধ প্রতিষ্ঠানে পাঠিয়ে দেয়। ওই দুধ প্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে প্যাকেটজাত তরল দুধ, গুঁড়োদুধ, ঘি, মাখন, কনডেন্স মিল্ক ও আইসক্রিমসহ নানা দুগ্ধজাত খাদ্যসামগ্রী তৈরি করে পরিবেশকের মাধ্যমে ওইসব কোম্পানি সারাদেশে সরবরাহ করে যা দেশের দুধের চাহিদার সিংহভাগ পূরণ করছে।
আপনার মতামত লিখুন :