• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর, ২০২৪, ৩ কার্তিক ১৪৩১

বর্ষীয়ান জননেতা মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক মরহুম মির্জা মোরাদুজ্জামান এর ইতিহাস


FavIcon
জহুরুল ইসলাম:
প্রকাশিত: জুলাই ১২, ২০২৪, ০৭:৩৯ পিএম
বর্ষীয়ান জননেতা মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক মরহুম মির্জা মোরাদুজ্জামান এর ইতিহাস

সিরাজগঞ্জ সদর থানাধীন কাওয়াকোলা ইউনিয়নের অন্তর্গত কুড়িপাড়া গ্রামে ১৯৩৯ সালের ১১ই মার্চে এক সম্রান্ত কৃষক পরিবারে মির্জা মোরাদুজ্জামান জন্ম গ্রহন করেন। পিতা মির্জা জহিরউদ্দিন ছিলেন তদানিন্তন কংগ্রেস আন্দোলনের একজন স্থানীয় নেতা। মির্জা মোরাদুজ্জামান সিরাজগঞ্জ মুসলিম হাই স্কুলে ছাত্রাবস্থায় প্রত্যক্ষ রাজনীতির সাথে জড়িত হয়ে পড়েন। ৫২’র ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়েই রাজনীতিতে সক্রিয়তা বেড়ে ওঠে। তৎকালীন ছাত্র ফেডারেশন, ছাত্র ইউনিয়ন থেকে ১৯৫৭ সালে মাওলানা ভাসানী প্রতিষ্ঠিত ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে যোগ দেন। সিরাজগঞ্জ মহকুমা ন্যাপের সম্পাদকের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বিড়ি-শ্রমিকদের সংগঠন ও রিক্সা-টমটম গাড়ি শ্রমিকদের সংগঠিত করেন এবং উক্ত ২টি সংগঠনের সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এভাবে মির্জা মোরাদুজ্জামান শ্রমিক নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হন। তিনি ছিলেন সৎ, দায়িত্ববান এবং নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি আর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতায় বিশ্বাসী। 

১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের মধ্যে বিড়ি-শ্রমিকদের সংগঠিত করে তাদের বাঁচার দাবী পাট-সমৃদ্ধ সিরাজগঞ্জে জুটমিল প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন শুরু  করেন। এই আন্দোলনের ফলে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের গর্ভনর জেনারেল আজম খান সিরাজগঞ্জে আসেন এবং নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনার পর জুট মিল প্রতিষ্ঠার পর বহু বেকার বিড়ি শ্রমিক জুট মিলে চাকরি পায়। ১৯৬৩ সালে মিল শ্রমিকদের নিয়ে কওমী মজদুর ইউনিয়ন গঠনেও তিনি মূখ্য ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬৪ সালে কওমী জুট মিলের শ্রমিক নেতৃবন্দ কারাগারে গেলে তিনি ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। এই সময় সম্মিলিত বিরোধী দলের প্রার্থী হিসেবে তিনি সিরাজগঞ্জ পৌরসভার নির্বাচনে বিপুল ভোটে সদস্য নির্বাচিত হন এবং কাওয়াকোলা ইউনিয়নের বিডি মেম্বর নির্বাচিত হন। ১৯৬৭ সালে আইয়ুব খান এবং পাক গর্ভণর মোনায়েম খান বিরোধী শ্রমিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে মির্জা মোরাদুজ্জামান সহ ১৭ জন নেতা কর্মী গ্রেফতার হন। দীর্ঘ ১১ মাস কারা ভোগের পর তিনি আবারো রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। মির্জা মোরাদুজ্জামান অকুতোভয় নেতা মাওলানা ভাসানীর রাজনীতিকে উর্ধ্বে তুলে ধরেন। তিনি ন্যাপের সভাপতি নির্বাচিত হন। পাকিস্তান শাসক গোষ্ঠী ১৯৭১ সালে ২৫ শে মার্চ নিরীহ বাঙ্গালীদের হত্যা যজ্ঞে মেতে উঠে। 

এ সময় মির্জা মোরাদুজ্জামান মাওলানা ভাসানীর সাথে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ ও মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করেন এবং বর্হিবিশ্বের স্বাধীনতার পক্ষে চাপ সৃষ্টির জন্য নদী পথে আসাম দিয়ে যাত্রা শুরু করলে পতিমধ্যে ভারত সরকার তাদেরকে আমন্ত্রণ জানান ও বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন। 
১৯৭৬ সালে মাওলানা ভাসানীর মৃত্যুর পর এবং শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বিএনপি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করলে মির্জা মোরাদুজ্জামান বিএনপি গঠনে ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে পড়েন। মির্জা মোরাদুজ্জামান বিএনপি'র জাতীয় নির্বাহী কমিটির প্রথম আহবায়ক কমিটি'র প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পান এবং সিরাজগঞ্জ জেলা বিএনপি'র’ সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ও পরবর্তীতে তিনি বিএনপি কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প বিষয়ক সম্পাদক, সর্বশেষে তিনি বিএনপি'র জাতীয় নির্বাহী কমিটি'র তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। সেই সাথে ১৯৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকায় থাকার কারণে স্বৈরাচারের স্থানীয় দোসরদের ষড়যন্ত্রে দৈহিক নির্যাতনের শিকার হন ও কারা নির্যাতন ভোগ করেন।

স্বৈরাচারের পতনের পর ১৯৯১ সালে ৫ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিরাজগঞ্জ সদর আসন থেকে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী হিসাবে মির্জা মোরাদুজ্জামান বিপুল ভোটে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।  জনগণের প্রতিনিধি হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণের পর সার্বজনীন কাজের দিকে তিনি নজর দেন। 

মির্জা মোরাদুজ্জামান মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাষ্টি বোর্ডের সদস্য, শ্রম ও জনশক্তি মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের পরিচালক ছিলেন। জনপ্রতিনিধি হিসাবে মির্জা মোরাদুজ্জামান অন্যদের চাইতে আলাদা বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। আবালবৃদ্ধবণিতা সর্বশ্রেণী-পেশার মানুষ তার কাছে অবাধে যেতেন এবং তাদের দুঃখ-কষ্টের কথা, সমস্যার কথা অকপটে বলতে পারতেন। সে কারণে তিনি হয়েছিলেন সবার প্রিয় ‘‘মুরাই ভাই’’।। 
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সহযোগীতায় স্কুল, কলেজ, মসজিদ-মাদ্রাসা, কবরস্থান, মন্দির, রাস্তা-ঘাট, ব্রীজ-কালভাট নির্মাণে তার সক্রিয় সহযোগিতা কালের স্বাক্ষী হিসাবে আজও দাঁড়িয়ে আছে। সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে রুপান্তর ও অনার্স-মাস্টার্স কোর্স চালু করেন। বাণিজ্য ভবন, ছাত্র/ছাত্রীদের জন্য হোস্টেল নির্মাণসহ মাওলানা ভাসানী ডিগ্রী কলেজ, যমুনা ডিগ্রী কলেজ, শিমলা ডিগ্রী কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন এবং বাগবাটি (আব্দুলস্নাহ আল মাহমুদ) ডিগ্রী কলেজ এম.পি.ও ভুক্ত করেন। এছাড়াও সিরাজগঞ্জ শহীদ শামসুদ্দিন ষ্টেডিয়াম, সদর হাসপাতাল আধুনিকরণ, নার্সিং ট্রেনিং ইন্সষ্টিটিউট প্রতিষ্ঠা, সিরাজগঞ্জ বার ভবন ও যমুনা বহুমূখী সেতু নির্মাণে অগ্রণী ভুমিকা পালন করেন। 

মৃত্যুব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হবার কারণে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করার পর অবস্থার অবনতি ঘটলে  তাকে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ভারতের বোম্বে টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য প্রেরণ করা হয়। সেখানে অল্প কিছুদিন চিকিৎসার পর তিনি দেশে ফিরে আবারো অসুস্থ হয়ে পড়লে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পুনরায় ভর্তি হন। তিনি মৃত্যু পথযাত্রী হয়েও নিজের কথা, নিজের পরিবারের কথা চিন্তা না করে জাতীয় সংসদে ১০ জুলাই ১৯৯৫ সালে জীবনের শেষ বক্তব্যে সরকারের কাছে নিজের এলাকার জনগণের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবের কথা, উন্নয়নের কথা, উন্নয়নের মাঝে বেঁচে থাকার কথা বলেছেন এবং বাংলাদেশে একটি আধুনিক ক্যান্সার ইন্সষ্টিটিউট গড়ে তোলার জন্য সরকারের কাছে জোড় দাবী উত্থাপন করেন। তিনি ১৯৯৫ সালের ১৮ জুলাই ভোরে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে চিকিসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।

তৎক্ষনাৎ মির্জা মোরাদুজ্জামানের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। 

মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক মরহুম মির্জা মোরাদুজ্জামানের মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান করে । 

১ম জানাযা জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় এবং ২য় জানাযা অনুষ্ঠিত হয় বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় নয়া পল্টনের সামনে। 
জানাযায় শরীক হন মাননীয় উপ প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের সদস্যবৃন্দ এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন এর নেতৃবৃন্দ। 
 
মৃত্যুর পর হেলিকাপ্টার যোগে তাঁর মরদেহ সিরাজগঞ্জে আনা হলে সর্বজনবিদিত প্রিয় নেতার মুখ শেষ বারের মতো দেখার জন্য শোকার্ত মানুষের ঢল নামে। প্রবীণ জননেতা সিরাজগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীণ সভাপতি মরহুম মোতাহার হোসেন তালকুদারসহ জেলার সব দলের নেতৃমন্ডলী ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার সংগঠনের প্রতিনিধিবৃন্দ সিরাজগঞ্জ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ মাঠে লাখো জনতার সেই শোক সমাবেশে স্মৃতিচারণ করে আবেগ ঘন বক্তব্য রাখেন এবং জানাযা শেষে সিরাজগঞ্জ জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ রাষ্ট্রীয় সম্মান জানানোর পর মরহুমের মৃত দেহ মালশাপাড়া কবরস্থানে দাফন কার্য সম্পন্ন করা হয়।

মরহুম মির্জা মোরাদুজ্জামানের স্মৃতি প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁর সম্মানে সিরাজগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের বাণিজ্য ভবনকে মির্জা মোরাদুজ্জামান ভবন, সিরাজগঞ্জ সদর হাসপাতালে সম্প্রসারিত ভবনকে মির্জা মোরাদুজ্জামান ভবন, সিরাজগঞ্জ আন্তঃজেলা বাস টার্মিনালকে মির্জা মোরাদুজ্জামান বাস টার্মিনাল, সিরাজগঞ্জ পৌরসভা ও ইউনিয়নের বিভিন্ন রাস্তার নামকরণ এর প্রস্তাব গৃহীত হয়। 

তাঁর বিদ্রেহী আত্মার প্রতি মাগফিরাত কামনা ও শোকসন্তপ্ত  পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে বাণী প্রেরণ করেন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া, সংসদ উপনেতা বি. চৌধুরী, বিএনপি'র প্রয়াত মহাসচিব আব্দুল মান্নান ভুঁইয়া (মন্ত্রী), প্রয়াত প্রতিমন্ত্রী ব্যারিষ্টার আমিনুল হক, প্রয়াত প্রতিমন্ত্রী সাদেক হোসেন খোকা, আমানউল্লাহ আমান, রাশেদ খান মেনন ও প্রয়াত ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিন প্রমুখ। 

মির্জা মোরাদুজ্জামানের মরদেহ মালশাপাড়া কবরস্থানে তাঁর ছোট ভাই কমরেড মানিরুজ্জামান তাঁরা’র কবরের পাশেই সমাহিত করা হয়।

কমরেড মনিরুজ্জামান তাঁরা স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ গ্রহণের পর আওয়ামী দুঃশাসন একদলীয় বাকশাল গঠনের বিরুদ্ধে বামপন্থী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়ায় তাকে গ্রেফতার এবং রাজধানী ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বের করে এনে রক্ষাীবাহিনী ক্যাম্পে সারারাত পাশবিক নির্যাতনের পর রাতের অন্ধকারে স্থানীয় মালশাপাড়া কবরস্থানের পার্শ্বে গুলি চালিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে ফেলে রাখা হয়। 

মৃত্যুকালে মির্জা মোরাদুজ্জামান তার স্ত্রী মনোয়ারা বেগম এবং দুই পুত্র ও তিন কন্যা সহ আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহকর্মী এবং বহু গুনগ্রাহী রেখে যান। 

তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র মির্জা মোস্তফা জামান জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সংসদের সিনিয়র সদস্য, সিরাজগঞ্জ জেলা ছাত্রদলের সভাপতি, সিরাজগঞ্জ জেলা বিএনপি'র ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক ও সিরাজগঞ্জ জেলা বিএনপি’র যুগ্ম আহবায়ক এর দায়িত্ব পালন করেছেন।
 
মির্জা মোস্তফা জামান বর্তমানে সিরাজগঞ্জ জেলা বিএনপি’র সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে সুনামের সহিত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। 
 


Side banner
Link copied!